দেশে উচ্চশিক্ষা টিভি চ্যানেল স্থাপনের যথার্থতা

  • by
  • May 6, 2020
  • 291 views

প্রফেসর ড. মো. সাজ্জাদ হোসেন

মানবসভ্যতার উন্নয়নে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি যত আশীর্বাদ বয়ে এনেছে তার মধ্যে অন্যতম হলো টেলিভিশন আবিষ্কার। টেলিভিশন এ যুগের সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং প্রভাবশালী গণমাধ্যম।

১৯২৫ সালে এই দূরদর্শন যন্ত্রটি আবিষ্কৃত হলেও সর্বপ্রথম এর ব্যবহার হয় ইংল্যান্ডে ১৯৩০ সালে। ১৯৬৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে, পাকিস্তান টেলিভিশনের ঢাকা কেন্দ্রের উদ্বোধন হয়।

পরবর্তীতে সরকারিভাবে ১৯৬৮ সালে রামপুরা টিভি সম্প্রচার কেন্দ্র চালু হয়। মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর পাকিস্তান টেলিভিশন বাংলাদেশ টেলিভিশনে রূপান্তরিত হয়।

১৯৭৬ সালে বেতবুনিয়া ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্রের (দেশের প্রথম ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র যেটি ১৪ জুন, ১৯৭৫ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু উদ্বোধন করেন) মাধ্যমে প্রথম ঢাকার বাইরে টিভি সম্প্রচার শুরু হয়।

১৯৯৭ সালের ডিসেম্বরে চট্টগ্রামে টিভি কেন্দ্র চালু হয়। একসময় উচ্চবিত্তদের ঘরে শোভা পেলেও এখন টেলিভিশন সহজলভ্য হওয়ায় পৌঁছে গেছে ঘরে ঘরে।

স্যাটেলাইটের কল্যাণে বাংলাদেশের প্রায় ৮০ শতাংশ পরিবারে টেলিভিশন রয়েছে। টেলিভিশন নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গীতাঞ্জলি কাব্যের ‘কত অজানারে জানাইলে তুমি’ কবিতার কিছু লাইন খুবই প্রাসঙ্গিকভাবে মনে পড়ছে-

‘কত অজানারে জানাইলে তুমি, কত ঘরে দিলে ঠাঁই- দূরকে করিলে নিকট, বন্ধু, পরকে করিলে ভাই।’

সংবাদ, সংস্কৃতি ও বিনোদনের পাশাপাশি শিক্ষা প্রসারে টেলিভিশনের ভূমিকা অপরিসীম। কোভিড-১৯ রোগের প্রাদুর্ভাবে সারাবিশ্বের অসহায়ত্ব অবস্থা এটাই ভাবায় যে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা আরও বাস্তবমুখী এবং সময়োপযোগী হওয়া প্রয়োজন।

এক্ষেত্রে টেলিভিশনের মাধ্যমে শিক্ষাদান বর্তমানে আলোচিত এবং সর্বাধিক প্রাসঙ্গিক বিষয়। বর্তমানে বিশ্বের অনেক দেশ অনলাইনের পাশাপাশি টেলিভিশন চ্যানেলের মাধ্যমে সফলভাবে উচ্চশিক্ষা প্রদান করছে।

বাংলাদেশের বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে বিভিন্ন বিষয়ে পাঠদান করা হচ্ছে যার বেশির ভাগই স্কুলের শিক্ষার্থীদের জন্য।

করোনাভাইরাস রোধে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছুটির কারণে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার ধারাবাহিকতা রক্ষায় ‘সংসদ বাংলাদেশ টেলিভিশনে’ প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের জন্য বিষয়ভিত্তিক পাঠদান কর্মসূচি ‘ঘরে বসে শিখি’ গ্রহণ করা হয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এখনও এ ধরনের কার্যক্রম দেখা যাচ্ছে না। অথচ বিশ্বের অনেক দেশই রয়েছে শিক্ষার জন্য আলাদা টেলিভিশন।

টেলিভিশনকে শিক্ষামূলক মাধ্যম হিসেবে ব্যবহারের বিষয়টি সর্বপ্রথম ১৯৩২ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আইওডব্লিউএর স্টেট ইউনিভার্সিটি দ্বারা একটি বিশ্বমেলায় পরীক্ষামূলক ভিত্তিতে প্রকাশিত হয়েছিল।

পরবর্তীকালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে টেলিভিশনের ভূমিকা মন্থর হয়ে যায় এবং এর ফলস্বরূপ শিক্ষাব্রতীদের ব্যাপক আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও খুব কম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান টেলিভিশনকে শিক্ষামূলক মাধ্যম হিসেবে ব্যবহারের সাথে জড়িত ছিল।

শিক্ষাগত উদ্দেশ্যে টেলিভিশনের গুরুত্ব উপলব্ধি করে, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ফেডারেল যোগাযোগ কমিশন’ ১৯৫২ সালে অলাভজনক ও অ-বাণিজ্যিক ভিত্তিতে শিক্ষামূলক সম্প্রচারের জন্য ২৪২টি ফ্রিকোয়েন্সি সংরক্ষণ করেছিল’।

দূরবর্তী শিক্ষণ শিক্ষা পদ্ধতির অগ্রদূত ধরা হয় দ্য ইউকে ওপেন ইউনিভার্সিটি কর্তৃক টেলিভিশনের শিক্ষামূলক ব্যবহারের জন্য।

১৯৬০ এর দশকে শিক্ষামূলক টেলিভিশন স্টেশনগুলোর সংখ্য দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছিল এবং ১৯৭২ সালের মধ্যে ২৩৩টি শিক্ষাকেন্দ্রের সংখ্যা ছিল (কার্নেগি কমিশন, ১৯৭৯)।

ওহিও বিশ্ববিদ্যালয়, টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয় এবং মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয় অন-ক্যাম্পাস এবং অফ-ক্যাম্পাস উভয় শিক্ষার্থীদের জন্য নেটওয়ার্ক তৈরির সর্বপ্রথম বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল।

ভারতে টিভি নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠার পর থেকে টেলিভিশনকে শিক্ষা এবং উন্নয়নের দক্ষ মাধ্যম হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।

এটি প্রাথমিক, মাধ্যমিক এবং বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের শিক্ষার শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে শিক্ষার্থীদের আকর্ষণ করেছে।

কয়েকটি বড় বড় টেলিভিশন প্রকল্পও গ্রহণ করা হয়। এর মধ্যে অন্যতম একটি প্রকল্প হলো ‘ইউজিসি-উচ্চশিক্ষা টেলিভিশন প্রকল্প (এইচইটিভি) (১৯৮৪)’। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এই প্রকল্পের উপকারভোগী ছিল।

এই কর্মসূচির আওতায় বিভিন্ন বিষয়ে ইংরেজিতে এক ঘণ্টার কর্মসূচি উপস্থাপন করা হয়। এই প্রকল্পটি শিক্ষার্থী, শিক্ষক এবং অন্য শিক্ষার্থীদের মধ্যে খুব জনপ্রিয়।

ওপেন ইউনিভার্সিটি অব জাপান (ওইউজে) টেলিভিশন এবং রেডিওর মাধ্যমে প্রতি সেমিস্টারে ১৫ বার (প্রতিটি লেকচার ৪৫ মিনিটের) সম্প্রচার করা হয়।

যদি কেউ কোনো কারণে কোনো লেকচারে অংশগ্রহণ করতে ব্যর্থ হয়, একটি স্টাডি সেন্টারে সেটির পর্যালোচনা করতে পারে। বেশিরভাগ টেলিভিশন পাঠদান এবং সমস্ত রেডিও বক্তৃতাও ইন্টারনেটের মাধ্যমেও উন্মুক্ত করা হয়।

এশিয়ার চীনে ৪৪টি রেডিও এবং টিভি বিশ্ববিদ্যালয় আছে (চায়না কেন্দ্রীয় রেডিও এবং টিভি বিশ্ববিদ্যালয়সহ)। ইন্দোনেশিয়ার টারবুকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং ভারতের ইন্দিরা গান্ধী ন্যাশনাল ওপেন ইউনিভার্সিটি রেডিও ও টেলিভিশন শিক্ষার প্রচলন করেছে। জাপান বিশ্ববিদ্যালয় ২০০০ সালে রেডিওর জন্য ১৬০টি এবং টেলিভিশনের জন্য ১৬০টি কোর্স চালু করেছে।

টেলিভিশনের মাধ্যমে শিক্ষাদান-শেখার প্রক্রিয়াটির অনেক উপকারী দিক রয়েছে। এই মাধ্যমটি দ্বারা আমাদের সেরা প্রশিক্ষক/শিক্ষকদের মধ্য থেকে একজন সেরা প্রশিক্ষক/শিক্ষককে নির্বাচন করে সকল শিক্ষার্থীর জন্য তার লেকচার/নির্দেশনা সুবিধা সমানভাবে পৌঁছে দেয়া যায়। টেলিভিশন সকল শিক্ষার্থীর জন্য একটি সামনের সারির আসন নিশ্চিত করে।

কারণ এখানে শ্রেণিকক্ষের মতো নির্দিষ্ট/সীমিত সংখ্যক আসনের ব্যাপারটি নেই। এটিতে অডিও এবং ভিজ্যুয়াল প্রযুক্তির সংমিশ্রণের অনন্য বৈশিষ্ট্য রয়েছে এবং এটি অডিও মিডিয়ার চেয়ে অধিক কার্যকর হিসেবে বিবেচিত হয়।

এটি বিনোদন, তথ্য এবং শিক্ষার একাধিক উদ্দেশ্যে পরিবেশন করে। ইন্টারনেটনির্ভর শিক্ষাদানের তুলনায় এটি অনেক সহজেই অ্যাক্সেসিবল এবং সাশ্রয়ীও! টেলিকনফারেন্স এবং টেলিটেক্সিংয়ের মাধ্যমে টেলিভিশনকে শিক্ষা বিস্তারে আরও ফলপ্রসূ করে ব্যবহার করা যায়।

আমরা এখন ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড উপভোগ করছি। আমাদের তরুণ জনগোষ্ঠীর (১৫-৩৫ বছরের) সংখ্যা আট কোটি।

টেলিভিশনের মাধ্যমে তরুণদের রি-স্কিলিং (নতুন স্কিল/পেশাগত শিক্ষায়) প্রশিক্ষণ/পাঠদান করলে তারা আর বেকারত্বের অভিশাপ বয়ে বেড়াবে না। বরং তারা নিজেদের কর্মসংস্থানের পাশাপাশি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে।

বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশও। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রথম থেকেই এদেশকে একটি স্বনির্ভর আধুনিক ডিজিটাল বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য ফ্রেমওয়ার্ক- ভিশন ২০২১, ২০৩০, ২০৪১ (উন্নত বাংলাদেশ) এবং ডেল্টা প্ল্যান দিয়েছেন।

তিনি দিনরাত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার জন্য। আমরা ২০৭১ সালে স্বাধীনতার একশ বছর উদযাপন করব।

ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর দৌহিত্র সজীব ওয়াজেদ জয়ের পরিকল্পনায় এদেশ আধুনিক প্রযুক্তিতে এগিয়ে যাচ্ছে। তার অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলেই ডিজিটাল বাংলাদেশ এখন আর স্বপ্ন নয়, বাস্তব।

শিক্ষা ক্ষেত্রেও প্রযুক্তির সমন্বয়ের ফলে প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় স্তর পর্যন্ত পৌঁছে গেছে ডিজিটাল সুবিধা। ই-লার্নিং, মাল্টিমিডিয়া শ্রেণিকক্ষ, আধুনিক বিশেষায়িত ল্যাব স্থাপন আমাদের চতুর্থ শিল্পবিপ্লবে সামিল হয়ে এগিয়ে যেতে সহায়ক হবে।

আমার বিশ্বাস এক্ষেত্রে টেলিভিশনের মাধ্যমে উচ্চশিক্ষাসহ যেকোনো ট্রেড/দক্ষতা শিক্ষার প্রসার অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রায় এগিয়ে চলা বাংলাদেশকে আরও এগিয়ে যেতে সহায়ক হবে।

এ বছরটি জাতির পিতার জন্মশতবর্ষ। তাই ‘উচ্চশিক্ষা টিভি’ নামে (অথবা অন্য কোনো নামে) একটি টেলিভিশন চ্যানেল প্রতিষ্ঠা বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষার অনেক সংকট সমাধানের পাশাপাশি দক্ষ জনশক্তি তৈরি করার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা বিনির্মাণে যুগান্তকারী অবদান রাখবে।

লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ; সদস্য, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন(ইউজিসি) এবং পরিচালক, বাংলাদেশ কমিউনিকেশন স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেড (বিসিএসসিএল)। সূত্রঃ জাগোনিউজ। সম্পাদনা অ/হো। ম ০৬০৫/১৮

Related Articles